৫০ দিন ভেন্টিলেশনে থেকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা – টালিগঞ্জের এম.আর. বাঙুর হাসপাতালের এক অসাধারণ সাফল্য
মানব জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলির মধ্যে একটি হল দীর্ঘমেয়াদি কোমা ও ভেন্টিলেশনের উপর নির্ভরশীলতা। সম্প্রতি এম.আর. বাঙুর হাসপাতালে ঘটেছে এক বিরল চিকিৎসা সাফল্যের কাহিনি।
রোগীর পটভূমি
৩৭ বছরের সমর দাস, আসানসোলের রানিগঞ্জের বাসিন্দা। পেশায় গাড়ি চালক। একদিন গাড়ি চালানোর সময়েই তিনি হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। দ্রুত বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হলে নিউরো সার্জারি করা হয়, তবে অবস্থার অবনতি ঘটে। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি কোমায় চলে যান।
মারাত্মক জটিলতা
সমরের ব্রেনের যে অংশ শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে, সেটি কার্যত কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এর সঙ্গে যোগ হয় Acute Respiratory Distress Syndrome (ARDS)। কিডনি ও লিভারও ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। জীবন বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে টালিগঞ্জের এম.আর. বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
৫০ দিনের লড়াই
২০ জুন থেকে সমরকে রাখা হয় হাসপাতালে। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে করা হয় ট্র্যাকিওস্টমি, যাতে কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস চালানো যায়।
টানা ৫০ দিনেরও বেশি সময় তিনি কাটিয়েছেন সিসিইউ-র ৭০৩ নম্বর বেডে।
প্রতিদিন চলেছে অ্যান্টিবায়োটিক, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, ইনজেকশন এবং নিয়মিত চেস্ট ফিজিওথেরাপি।
বিশেষ দিকটি হল, পরিবারকে একটি অ্যান্টিবায়োটিকও বাইরে থেকে কিনতে হয়নি। সমস্ত ওষুধ, ইনজেকশন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী হাসপাতাল থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে।
চিকিৎসক দলের ভূমিকা
ডা. ওয়াই চৌহান, ডা. অনির্বাণ ভট্টাচার্য এবং সার্জন ডা. সোহম সামন্তর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ টিম দিনরাত এক করে লড়াই চালান। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নার্স ও কেয়ারগিভাররা, যারা টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে রোগীর প্রতি নজর রেখেছেন।
ধীরে ধীরে উন্নতি
অবশেষে ব্রেন ধীরে ধীরে সাড়া দিতে শুরু করে। ফুসফুস সক্রিয় হয়, কিডনি ও লিভারের কার্যক্ষমতাও বাড়তে থাকে। কয়েক সপ্তাহ পর সমরের গলার ট্র্যাকিওস্টমি টিউব সরানো হয়। দেখা যায়, তিনি নিজে থেকেই শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে সক্ষম হয়েছেন।
পরিবারের অনুভূতি
সমরের স্ত্রী অপর্ণা দাস টানা হাসপাতালে থেকে স্বামীর সেবাযত্ন করেছেন। তাঁর কথায় –
“এখন আগের থেকে অনেকটাই ভালো আছেন। খাইয়ে দিলে নিজে থেকে খাচ্ছেন। শ্বাসও নিচ্ছেন স্বাভাবিকভাবে। তবে এখনও সবাইকে চিনতে পারেন না। আমাদের ছ’বছরের একটা মেয়ে আছে। উনিই আমাদের একমাত্র উপার্জনশীল মানুষ। ডাক্তারবাবুদের জন্যই উনি আজ বেঁচে আছেন।”
চিকিৎসকদের মত
ডা. সোহম সামন্ত জানান –
“রোগীর ছিল হেমারেজিক ব্রেন স্ট্রোক। ব্রেনের বাঁদিকের মারাত্মক ক্ষতির কারণে স্মৃতিশক্তি এখনও অস্পষ্ট। তবে শারীরিক উন্নতি উল্লেখযোগ্য। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি ও চিকিৎসার মাধ্যমে আরও ভালো উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে।”
উপসংহার
সমর দাসের এই কাহিনি শুধু এক রোগীর বেঁচে ওঠার গল্প নয়, বরং চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতাল ও পরিবারের অক্লান্ত প্রচেষ্টার এক জীবন্ত প্রমাণ। এম.আর. বাঙুর হাসপাতালের এই চিকিৎসা সাফল্য দেখিয়ে দিল, যথাযথ চিকিৎসা ও মানসিক দৃঢ়তা থাকলে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকেও ফিরে আসা সম্ভব।



