মস্তিষ্কেও লাগানো যায় পেসমেকার: পার্কিনসন ও ট্রেমরের রোগে আশার আলো ‘ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন’
আমরা জানি, হৃদরোগে পেসমেকার বসিয়ে হার্টের ছন্দ ঠিক রাখা যায়। ঠিক তেমনই, কিছু নির্দিষ্ট স্নায়বিক রোগে মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পাঠিয়ে উপশম আনা সম্ভব। এই আধুনিক চিকিৎসার নাম ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন (DBS)। এটি এক ধরনের ‘ব্রেন পেসমেকার’ যা পার্কিনসন, ডিসটোনিয়া, ট্রেমর বা এপিলেপসির মতো রোগে ব্যবহার হয়।
কীভাবে কাজ করে ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন?
মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশ যদি ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলে হাত-পা কাঁপা, দাঁড়াতে অসুবিধা, খেতে সমস্যা ইত্যাদি দেখা দেয়। এই সমস্যাগুলি মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল ডিসচার্জের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফল।
এই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মস্তিষ্কে দু’টি সূক্ষ্ম তার বসানো হয়। তারপরে ওই তারগুলো চামড়ার নিচে কানের পাশ দিয়ে গিয়ে কলার বোনের নীচে একটি যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই যন্ত্র নির্দিষ্ট সময় অন্তর বৈদ্যুতিক ইমপালস পাঠায়, যা মস্তিষ্কের কাজে সহায়তা করে।
কোন কোন রোগে ব্যবহার হয়?
এই পদ্ধতিতে পার্কিনসন, ডিসটোনিয়া ও ট্রেমরের মতো মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার-এ ভালো ফল মেলে। রোগ অনুযায়ী মস্তিষ্কের বিভিন্ন নিউক্লিয়াসকে লক্ষ্য করা হয়—
-
পার্কিনসন’স: সাবথ্যালামিক নিউক্লিয়াস
-
ডিসটোনিয়া: গ্লোবাস প্যালিডাস ইন্টারনাস
-
ট্রেমর: ভেন্ট্রাল ইন্টারমিডিয়েট নিউক্লিয়াস অব থ্যালামাস
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সতর্কতা
ডিবিএস-এর পর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে—
-
অস্ত্রোপচারের ফলে রক্তপাত বা সংক্রমণ
-
যন্ত্রের তারে সমস্যা
-
মুখ বেঁকে যাওয়া, হাত-পা টান পড়া বা চোখে ডাবল দেখা
-
হাত-পায়ে চিমচিমে ভাব (সেন্সরি সমস্যার জন্য)
এই কারণেই রোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। ডিমেনশিয়া বা মানসিক সমস্যা থাকলে ডিবিএস না করানোই ভালো। এছাড়া বয়স ৭২ বছরের নিচে হলে সাধারণত চিকিৎসার ফল ভালো হয়।
কেমন হয় যন্ত্র?
বর্তমানে দুটি ধরণের যন্ত্র পাওয়া যায়:
-
নন-রিচার্জেবল (চলে ৫ বছর পর্যন্ত)
-
রিচার্জেবল (চলে ১০–১৫ বছর, ব্লুটুথ-এর মাধ্যমে চার্জ দিতে হয়)
এই যন্ত্র বসাতে খরচ শুরু হয় প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা থেকে। অস্ত্রোপচারের সময় একদিন লাগে। তারপর প্রায় এক মাস যন্ত্রটি বন্ধ রাখা হয়, এই সময়কে বলা হয় “হানিমুন পিরিয়ড”। তারপর প্রোগ্রামিং করে মেশিন চালু করা হয়।
চিকিৎসার সুফল
-
ওষুধের প্রয়োজন অনেকটাই কমে যায়
-
কাঁপুনি ও চলাফেরার সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে
-
জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়
-
রোগী সাধারণ জীবনযাপন করতে পারেন
তবে চৌম্বক ক্ষেত্র (যেমন: বিমানবন্দর বা শপিং মল) এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়।
উপসংহার
‘ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন’ এখন আর শুধুই উন্নত বিশ্বের চিকিৎসা নয়। কলকাতার মতো শহরেও সফলভাবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ হচ্ছে। হার্টের পেসমেকারের মতোই মস্তিষ্কের জন্য এই প্রযুক্তি হতে পারে ভবিষ্যতের ভরসা।